রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া অপরাধীচক্র


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : জুলাই ২৫, ২০২২, ১:৫৯ পূর্বাহ্ন /
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া অপরাধীচক্র

 

নীলাকাশ টুডেঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীচক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্র নারী নির্যাতন, চুরি, ছিনতাই চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। চক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাশাপাশি বহিরাগতরাও রয়েছে।

কেবল ক্যাম্পাসে নয়; বিভিন্ন হোস্টেলেও তারা আস্তানা গড়ে তুলেছে। এমন একটি অপরাধীচক্রের নেতৃত্বে দিচ্ছেন চবি ছাত্র মোঃ আজিম। তার নেতৃত্বে চবিতে সর্বশেষ ছাত্রী হেনস্তা ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। এতে অংশ নেন আজিমসহ ৬ জন। যাদের মধ্যে ৫ জন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে।

এদিকে এই ছয় জনের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেফতার ছাত্ররা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী। আর রুবেল শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসাবে পরিচিত।

অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারে না।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে, অপকর্ম আড়াল করতে এই চক্রকে আর্থিকসহ নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। যে কারণে দিনদিন অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রী হেনস্তা ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের নেপথ্যে

১৭ জুলাই রাতে চবিতে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনার নেপথ্যে কিছু কারণ জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চবি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যে ছাত্রীটি হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তাকে প্রেমের প্রস্তাবসহ নানা কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল।

কিন্তু তার প্রস্তাবে সাড়া দেননি ওই ছাত্রী। মূলত এ কারণে ছাত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত ছিলেন রুবেল। ওই ছাত্রীর সঙ্গে চীনের জিয়াংঝু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি এক ছাত্রের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে।

ওই ছাত্র দেশে আসার পর চবি ক্যাম্পাসে আসেন প্রেমিকার (ছাত্রী) সঙ্গে দেখা করার জন্য। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হন রুবেল। তার (রুবেলের) অনুসারীরা ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় ছাত্রীর পথরোধ করে তার প্রেমিককে মারধর করে।

শুধু তাই নয়, ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে তারা। এমন ন্যক্কারজনক ও লজ্জানক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন ছাত্রী। পরদিন ওই ছাত্রী বিষয়টি চবি প্রশাসনকে জানাতে গেলে রুবেল পথরোধ করে হুমকি ধামকি দেন।

ঘটনার চার দিন পর ছাত্রী অজ্ঞাতনামা ৫ জনের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন। যদিও র‌্যাব বলছে, ৫ জনের নামে মামলা দায়ের করা হলেও তাদের তদন্তে ৬ জনের নাম এসেছে। এর মধ্যে ৫ জনকেই তারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত নয়। তাৎক্ষণিক।

অপরাধী চক্রের ৬ জনের কার কী পরিচয় : আজিমের নেতৃত্বাধীন অপরাধী চক্রের যে ৫ সদস্য গ্রেফতার হয়েছে তাদের বিষয়ে র‌্যাব বলছে, ছাত্রী হেনস্তার ঘটনার আগেও এদের কেউ কেউ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় নানা অপকর্ম করেছে। তাদের সবাই নিজেদের ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত বলেও দাবি করেছে।

একাধিক শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চবিতে ছাত্রী হেনস্তায় জড়িত আজিম এই চক্রের মূল হোতা হলেও এ ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বগিভিত্তিক সিএফসি সংগঠনের নেতা রেজাউল হক রুবেল।

ঘটনার পর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে নিয়ে আপস-মীমাংসার নানা চেষ্টা করেছিলেন তিনি। চবি ছাত্রলীগ সভাপতির ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের বিষয়টি জানাজানি হলে কেন্দ্র থেকে ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ’ এনে তাকে শোকজ করা হয়। এরপর ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ জমা দেন। থানায় মামলা করেন।

এদিকে চুরি, ছিনতাই, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে আজিমের বিরুদ্ধে। তার বাবার নাম মোঃ আমির হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী।

আজিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই ২০২০ সালে ছিনতাই ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জেলও খাটেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন বা পুকুরপাড় এলাকায় ছাত্রীরা বসলেই অশ্লীল মন্তব্য করতেন আজিম।

তার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে ওঠে অপরাধীচক্র। বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ ২য় বর্ষের ছাত্র আজিম বগিভিত্তিক সংগঠন সিএফসির অন্যতম সদস্য। শনিবার অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বোর্ড অব হেলথ, রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির বিশেষ সভায় আজিমকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

আজীবনের জন্য বহিষ্কার হওয়া দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে অপরজন হলেন নুরুল আবছার বাবু। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা বেলায়েত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরে চাকরি করেন। গ্রামের বাড়ি ফেনীর পরশুরাম বেড়াবাড়ি এলাকায়।

ছাত্রী হেনস্তায় অভিযুক্ত অপর তিনজন হলেন হাটহাজারীর ফতেপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জাবেদ হোসেনের ছেলে নুর হোসেন শাওন, ঝালকাঠির আশিয়ার এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে মাসুদ রানা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখায় কর্মরত শামসুল গাজীর ছেলে সাইফুল ইসলাম।

সাইফুলের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। সে হাটহাজারী কলেজের সাবেক ছাত্র। তারা স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে আজিমের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অপরাধজগতে পা বাড়ায়। ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় এই পাঁচজন ছাড়াও আরও একজন রয়েছেন বলে র‌্যাব জানিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রভোস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক সময় হলে বহিরাগতরা আস্তানা গড়ে তোলে। মাদকসেবন থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করে।