ইসির সংলাপে যে ৯ প্রস্তাব দিলো বাংলাদেশ কংগ্রেস


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : জুলাই ১৭, ২০২২, ১১:১৪ পূর্বাহ্ন /
ইসির সংলাপে যে ৯ প্রস্তাব দিলো বাংলাদেশ কংগ্রেস

ঢাকা প্রতিনিধিঃ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিন চারটি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানালেও একটি দল সংলাপে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে ইসি। 

রোববার (১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করে ইসি। এনডিএম এর পর বেলা সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) সঙ্গে বৈঠক করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমদিনের সংলাপের শেষ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কংগ্রেস ইসির বৈঠকে অংশগ্রহণ করে নয়টি প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসির সঙ্গে সংলাপে এ লিখিত প্রস্তাব পেশ করেন দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইয়ারুল ইসলাম। এসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

লিখিত বক্তব্যে ইয়ারুল ইসলাম জানায়, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আজও গড়ে ওঠেনি। ফলে দেশের প্রতিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে। “একাদশ সংসদ নির্বাচন” নামে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং সাড়ে তিন বছর অনায়াসেই পার করে দিয়েছে। সাধারণ হিসেবে আর মাত্র দেড় বছর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে যে পরিবেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংঘটিত হয়েছিল, তার সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। সংসদের তথাকথিত বর্তমান বিরোধী দল বা অতীতে ক্ষমতাভোগী বড় কোনো দল সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না। তারা বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললেও রহস্যজনক কারণে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো রকম তাগিদ দেখাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে এ অব্যবস্থা ও অনিয়মের নির্বাচন তারাও চাচ্ছেন।

দলটি মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইয়ারুল ইসলাম বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিগত সাড়ে তিন বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। ফলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সাম্প্রতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে, কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এই আয়োজন সেই ভোটাররা নির্বাচনে এখন আর ভোট দিতে আসেন না। বলতে গেলে, ২০১৮ সালের পরে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংশ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতি করে কোনো লাভ হবে না, তারা দেশের সেবা করার কোনো সুযোগ পাবে না। কেননা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় সরকারের ইচ্ছার বাইরে কেউ নির্বাচিত হতে পারছে না। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে যারা এভাবে নির্বাচিত হবে তাদের দ্বারা দেশ এগুবে না এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং তাদের হাত ধরে প্রশাসনসহ সর্বস্তরে দুর্নীতি ও অবক্ষয় বাড়বে এবং রাষ্ট্র ও সমাজে দেখা দেবে সীমাহীন অস্থিরতা।

বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলো হচ্ছে
১. ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংশোধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জন্ম, মৃত্যু ও বয়সের ভিত্তিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্পন্ন করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সরবরাহকরা তথ্য অনুসারে জাতীয় ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে।

২. সব ধরনের নির্বাচন পরিচালিত হতে হবে নির্বাচন কমিশনের দ্বারা এবং নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকবে। জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা/মহানগর নির্বাচন কর্মকর্তারা এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভা নির্বাচনে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসার নিযুক্ত হবেন। নির্বাচনকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।

৩. জাতীয় বাজেটের ০.০২ শতাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ করতে হবে, যা নির্বাচন কমিশন দলগুলোর মধ্যে সমহারে বন্টন করবে। রাজনৈতিক দলগুলো ওই অর্থ সমাজ কল্যাণমূলক কাজ ও দল পরিচালনায় ব্যয় করবে যার হিসাব বছরশেষে কমিশন বরাবর জমা দিতে হবে।

৪. নির্বাচনে সব প্রকার প্রচারণা হবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা অনুসারে। প্রার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত মুদ্রণ ফি গ্রহণপূর্বক নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর নাম ও ছবি সম্বলিত পোস্টার মুদ্রণ করে প্রার্থীদের মধ্যে সমসংখ্যক পোস্টার বিতরণ করবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে প্রার্থীরা ওই পোস্টার প্রদর্শন করবেন। তবে প্রার্থীরা নিজ উদ্যোগে মাইকিং ও হাতে হাতে প্রচারপত্র বিতরণ করতে পারবেন। নির্বাচনের দিন নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ ছুটি ঘোষণা করতে হবে এবং সব প্রকার অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। ভোট চলাকালীন দলীয় ক্যাম্প স্থাপন পরিচালনা, ভোটারবাহী পরিবহন ও জনসমাগম নিষিদ্ধ করতে হবে।

৫. ইলেক্ট্রোনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) অবস্থান ও পরিচালনায় গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে এবং ভোট দেওয়ার পর প্রতীকসহ মুদ্রিত টোকেন প্রদান পদ্ধতি চালু করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ভোটার ওই টোকেনের কপি নির্ধারিত বাক্সে ফেলবেন, যা সংরক্ষণ করতে হবে এবং মেশিনে প্রাপ্ত ভোট সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। তবে বাংলাদেশ কংগ্রেস ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে এবং ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে।

৬. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস আগে নির্বাচন কমিশন ওই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে এবং তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের বিদ্যমান সরকার ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বলে অভিহিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত যাবতীয় লোকবল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কর্তৃক মনোনীত একজন নির্বাচন কমিশনারের অধীনে এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলীর ক্ষমতা এককভাবে আরেকজন নির্বাচন কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত থাকবে।

৭. যে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অনুমোদিত বা নিবন্ধিত দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষণ সংস্থা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের অবাধ সুযোগ প্রদান করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের মতামত ও প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা প্রদান করা যাবে না।

৮. নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো ও দলীয় সদস্যদের যে কোনো বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে “পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল” ও “পলিটিক্যাল আপিলেট ট্রাইব্যুনাল” গঠন করতে হইবে। পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোনো কমিটি বা সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যাইবে। জেলা জজের সমমানের একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সমন্বয়ে পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। ট্রাইব্যুনালে আনা অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোনো কমিটি বা সদস্যকে যুক্তিসঙ্গত জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনালের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যাবে। একজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশন সচিবের সমন্বয়ে পলিটিক্যাল আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে।

৯. নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ সৃষ্টি, রাজনৈতিক সংষ্কৃতির উন্নয়ন, জবাবদিহিতা, দায়িত্ববোধ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নরোধ, পরমৎসহিষ্ণুতা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ ও নেতৃত্বের বিকাশ, মতামত গ্রহণ এবং নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে দলগুলোর চেয়ারম্যান ও মহাসচিবদের (বা সমমানের পদধারী) সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের যেকোন সময় দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করবে।